বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে নিরন্তর আলাপ আলোচনা হয়। স্বাধীনতার পর, আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা মূলত সরকারি পর্যায়ে সীমিত ছিল। বর্তমানে ৬৫ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা বেসরকারি পর্যায়ে হয়ে থাকে। তাই বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবাকে আরও গতিশীল, জনবান্ধব ও জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে। পাশাপাশি অন্যান্য সেবা ব্যবস্থাপনার মতো এ খাতকে যাতে টেকসই রাখা যায় সেদিকেও সরকারকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সীমিত সম্পদের মধ্যেও, একটি কার্যকর ও জনবান্ধব স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কিউবা একটা উদাহরণ হতে পারে। উত্তর আমেরিকার ছোট্ট এ দ্বীপ রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিকভাবে মোটামুটি অসচ্ছলই বলা যায়। ২০২০ সালে জিডিপির এক হিসাবে দেখা যায়, বিশ্বের ১৯৬টি রাষ্ট্রের মধ্যে কিউবার অবস্থান ৬৮তম। এদের মাথাপিছু আয় মাত্র ৯ হাজার ৯৯ ডলার। অর্থনৈতিকভাবে এতটা পিছিয়ে থাকার পরও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনায় কিউবা ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখিয়েছে। বিশ্বের স্বাস্থসেবার ইনডেক্সে তাদের বর্তমান অবস্থান ১৩তম! যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশের চেয়েও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনার দিক দিয়ে তারা এগিয়ে রয়েছে।
কিউবা সরকারের স্বদিচ্ছা, নীতিমালার বাস্তবায়ন এবং কার্যকর মনিটরিংয়ে তারা স্বাস্থসেবা খাতে এ উন্নতি করতে পেরেছে। স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি অগ্রাধিকার পেয়েছে তাদের সংবিধানে। ১৯৭৬ সালে কিউবার সংশোধিত সংবিধানের ৫০ ধারায়, সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি যুক্ত করা হয়।
কিউবার স্বাস্থ্যব্যবস্থার মূলভিত্তিটা হচ্ছে এর সুদৃঢ় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পদ্ধতি। ১৯৮৪ সালে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে তিনস্তরের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার কথা ঘোষণা করে। প্রাথমিক স্তরে সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্যবিষয়ক নানা ধারণা দেওয়া হয়, প্রতিষেধক সম্পর্কে অবহিত করা হয় এবং রোগের প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসা দেওয়া হয়। দেশের একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে সফলভাবে এ প্রাথমিক স্তরের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। বিষয়টা এতই বিস্তৃত যে, দেশের ৮০ শতাংশ জনগণকে এ প্রাথমিক স্তরের ওপরে আর যেতেই হয় না। প্রতিষেধক বিষয়ে সচেতন থাকা এবং রোগের শুরুতেই চিকিৎসা দিতে পারায় অধিকাংশ মানুষের রোগে সমাধান হয়ে যায়।
দ্বিতীয়স্তরে রয়েছে পলি ক্লিনিক ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা। অনেকটা আমাদের উপজেলা বা জেলা পর্যায়ের হাসপাতালের চিকিৎসার মতো। প্রাথমিক স্তরে যে চিকিৎসাগুলো সম্ভব হয় না, সেখানকার চিকিৎসকরা সেগুলোকে এই দ্বিতীয় স্তরে পাঠিয়ে দেয়। তৃতীয় স্তরে রয়েছে প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক উচ্চতর চিকিৎসা ব্যবস্থা। এরকম স্তরভিত্তিক চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে, ছোটখাটো রোগ নিয়ে কেউ আমাদের দেশের মতো মেডিকেল ইউনিভার্সিটি বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রফেসরদের কাছে যেতে পারে না। তাকে ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হয়, আর তার জন্য কোন ডাক্তারের পরামর্শটা জরুরি সেটা প্রাথমিক পর্যায়ের একজন জেনারেল ফিজিশিয়ানই নির্বাচন করে দেন।
কেবল রোগীর ক্ষেত্রেই নয়, চিকিৎসকদের জন্যও এ স্তরবিন্যাসের বিষয়টি কিউবাতে কঠোরভাবে পালন করা হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানে গ্রাজুয়েশনের পর সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে প্রাথমিক স্তরে ফ্যামেলি ফিজিশিয়ান হিসাবে কাজ করতে হয়। এখানে তাদেরকে টার্গেট দিয়ে দেওয়া হয়। ৬০০ থেকে ৭০০ মানুষ, আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ১৫০ পরিবারের চিকিৎসার দায়িত্ব দেওয়া হয় একজন ডাক্তার, একজন নার্স ও একজন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টের ওপর। এ পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্যের অবস্থা কেমন, তারা কতটা রোগে আক্রান্ত হলো, আক্রান্তের পর তাদের চিকিৎসা কেমন হবে, এসবের ওপরই নির্ভর করে দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পারফরম্যান্স।
প্রাথমিক স্তরের চিকিৎসকরা নিজেদের দায়িত্বটি বেশ গুরুত্ব দিয়েই পালন করে। কারণ, এখানকার পারফরম্যান্সের ওপরই নির্ভর করে সে উচ্চতর চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যায়নের সুযোগ পাবে কী না। ফলে সবসময়ই ৭০ শতাংশ ডাক্তার প্রাথমিক স্তরেই চিকিৎসায় নিয়োজিত থাকে। এর বাইরে সেখানকার স্বাস্থ্যসেবার প্রাথমিক স্তরে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়, সেটা হচ্ছে কমিউনিটি সম্পৃক্ততা। যখন কোনো বিশেষ রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়, যেমন কিছুদিন আগে হয়ে যাওয়া করোনা, কিংবা অনেকটা মৌসুমি রোগ হিসাবে পরিচিত ডেঙ্গু, এরকম সময় এসব রোগের প্রতিরোধ বা সচেতনতা সৃষ্টির জন্য স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করা হয়। স্থানীয় জনগোষ্ঠী থেকে কিছু নির্বাচিত ব্যক্তিকে সংশ্লিষ্ট রোগের বিষয় একটা প্রাথমিক জ্ঞান, প্রতিরোধ বিষয়ক সচেতনতা, ইত্যাদি দিয়ে রোগের ব্যাপকতা থামানোর চেষ্টা করা হয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি দশহাজার মানুষের জন্য কমপক্ষে ২৩ জন চিকিৎসক থাকা দরকার। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী কিউবায় প্রতি দশহাজার মানুষের জন্য চিকিৎসক রয়েছে ৬৭ জন। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশেও এই সংখ্যা ২৮ জন। আর বাংলাদেশে এই সংখ্যাটি হচ্ছে গড়ে প্রতি দশ হাজারের জন্য মাত্র ৪ দশমিক ৮ জনের মতো।
স্বাস্থ্যসেবায় কিউবার এই উদাহরণ থেকে আমরাও নতুন কিছু চিন্তা করতে পারি। আমাদের দেশেও, একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে, প্রায় ১৩/১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। এ ক্লিনিকগুলোতে একজন ডাক্তার, একজন প্রশিক্ষিত নার্স, একজন স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করে তাদের ওপর প্রতি একহাজার পরিবারের স্বাস্থ্য সচেতনতা ও চিকিৎসার দায়িত্ব দিতে পারি। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা, এ পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন প্রাথমিক রোগ-বালাইয়ের চিকিৎসা, কন্ট্রাসেপটিভ, পুষ্টিজ্ঞান এসব বিষয়ে কাজ করতে পারে। দেশের প্রতিটি মানুষের এখন যেহেতু এনআইডি আছে, তাই প্রাথমিক পর্যায়েই প্রত্যেককে তার এনআইডি নাম্বারের মাধ্যমে একটা স্বাস্থ্যবিষয়ক ডাটাবেজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হবে। এতে যে লাভটা হবে তা হলো, কোনো নাগরিক দেশের যে পর্যায়েই চিকিৎসা সেবার জন্য যাক না কেন, তার আগের সব রোগ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা ওষুধ গ্রহণের একটা ইতিহাস ডাক্তার পেয়ে যাবেন। এভাবে আশা করা যায় প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা একেবারে প্রাথমিক পর্যায়েই হয়ে যাবে। প্রাথমিক স্তরে যে রোগগুলোর চিকিৎসা সম্ভব নয়, কিংবা যেসব রোগের চিকিৎসা তুলনামূলকভাবে জটিল বা দীর্ঘমেয়াদি, তেমন রোগীদের প্রাথমিক স্তরের চিকিৎসকরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা জেলা পর্যায়ে পাঠিয়ে দেবে। জেলা পর্যায়ে সরকারি হাসপাতাল আছে, সে সঙ্গে আছে মাঝারি মানের বেশ কিছু বেসরকারি হাসপাতাল। এ হাসপাতালগুলোকে নিবিড়ভাবে মনিটরিং করবে সরকার। আবার সম্ভব হলে সরকার এগুলোর সঙ্গে এক ধরনের পার্টনারশিপেও যেতে পারে। এক্ষেত্রে ভারতে এরই মধ্যে সাফল্য পাওয়া ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্পটির কথা মাথায় রাখা যেতে পারে। যথাযথ রেফারেল পদ্ধতি যদি অনুসরণ করা হয়, তবে আশা করা যায়, ৯৫ থেকে ৯৮ শতাংশ রোগীর চিকিৎসাই জেলা পর্যায়ে হয়ে যাবে। বাকি ২ থেকে ৫ শতাংশ জটিল রোগী চিকিৎসার জন্য সুপার স্পেশালিটি, মেডিকেল কলেজ, মেডিকেল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে যাবে। রোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম থাকবে বলে এখানকার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা, জটিল এসব রোগের চিকিৎসা অধিকতর সময় ও গুরুত্ব দিয়ে করতে পারবেন। রোগীর সংখ্যা কম হওয়ায় সিনিয়র ডাক্তাররা রোগীদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগও রাখতে পারবেন।
যে কথাটা বলে শেষ করতে চাই সেটা হচ্ছে, চিকিৎসকদের পেশাগত উৎকর্ষ সম্পর্কে। চিকিৎসাবিদ্যা একটা চলমান বিজ্ঞান। প্রতিদিনই এক্ষেত্রে নতুন নতুন আবিষ্কার হচ্ছে, নতুন নতুন জ্ঞান ও প্রযুক্তি যুক্ত হচ্ছে। তাই নতুন এ সব জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে ডাক্তাররা কতটুকু নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারলেন তার পরীক্ষা হওয়া উচিত। সে লক্ষ্যে ডাক্তারদের যে রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়, সেটা প্রতি দুই বা তিনবছর পর পর একটা করে পরীক্ষার মাধ্যমে নবায়নের নিয়ম করা যেতে পারে। এভাবে সমন্বিত চিন্তা করলেই কেবল গুণগত ও লক্ষণযাগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে আমাদের চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থায়।
লেখক : ল্যাব এইড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।