ডা. এ এম শামীম ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ল্যাবএইড গ্রুপ। স্বাস্থ্যসেবা খাতে গ্রুপটি অবদান রাখছে মূলত চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ উৎপাদনের মাধ্যমে। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার মান, চিকিৎসা সেবার ব্যয়, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ ও আগামীর সম্ভাবনা নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পলাশ মাহমুদ।
ডা. এ এম শামীম: বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ৬০ শতাংশ বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়া থেকে শুরু করে পরবর্তী তিন বছরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবা খাত অনেক সংগ্রাম করেছে। প্রথম ছয় মাস করোনা সংক্রমিত রোগীরা বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারেননি। কারণ বেসরকারি হাসপাতালের সেই সেবা দেয়ার অনুমতি ছিল না। তবে করোনা মহামারী চলাকালে বাকি আড়াই বছর বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা সফলতার সঙ্গে এগিয়েছে। করোনার সময় চিকিৎসার জন্য রোগীদের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতাও ছিল না। চিকিৎসার অভাবে কোনো ব্যক্তি মারা গেছেন, এমনটাও আমরা শুনিনি। স্বাস্থ্য সেবা খাত নিয়ে সে রকম কোনো অসন্তুষ্টিও দেখা যায়নি। এখন করোনা পরবর্তী সময়ে এসে স্বাস্থ্য সেবা খাত খারাপ হয়েছে তেমনটা নয়; বরং আমি বলব করোনার ওই সময়ের মতো এখনও বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভালোভাবেই চলছে।
ডা. এ এম শামীম: বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ৬০ শতাংশ বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়া থেকে শুরু করে পরবর্তী তিন বছরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবা খাত অনেক সংগ্রাম করেছে। প্রথম ছয় মাস করোনা সংক্রমিত রোগীরা বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারেননি। কারণ বেসরকারি হাসপাতালের সেই সেবা দেয়ার অনুমতি ছিল না। তবে করোনা মহামারী চলাকালে বাকি আড়াই বছর বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা সফলতার সঙ্গে এগিয়েছে। করোনার সময় চিকিৎসার জন্য রোগীদের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতাও ছিল না। চিকিৎসার অভাবে কোনো ব্যক্তি মারা গেছেন, এমনটাও আমরা শুনিনি। স্বাস্থ্য সেবা খাত নিয়ে সে রকম কোনো অসন্তুষ্টিও দেখা যায়নি। এখন করোনা পরবর্তী সময়ে এসে স্বাস্থ্য সেবা খাত খারাপ হয়েছে তেমনটা নয়; বরং আমি বলব করোনার ওই সময়ের মতো এখনও বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভালোভাবেই চলছে।
দেশের চিকিৎসা খাতে সবচেয়ে বড় ঘাটতি হলো চাহিদা এবং জোগানোর ব্যবধান। জনবহুল এ দেশের মানুষের জন্য যতটা কার্যকর চিকিৎসা ব্যবস্থা তৈরির প্রয়োজন ছিল তেমনটা এখনো সম্ভব হয়নি। হাসপাতালগুলোতে রোগীদের জন্য যত সংখ্যক বেডের প্রয়োজন ততটা তৈরি করা সম্ভব হয়নি।
আমরা প্রায়ই শুনি মানুষ চিকিৎসা নিতে বিদেশে যান। এতে প্রতিবছর ৪ থেকে ৬ বিলিয়ন ডলার বাইরে চলে যায়। এই রোগীদের সেবা দেওয়ার মতো টারশিয়ারি কেয়ার বেড বেসরকারি খাতের হাসপাতালে রয়েছে মাত্র ১০ হাজার। ব্যক্তি খাতে পরিচালিত হাসপাতালগুলোতে বাকি ৯০ হাজার বেড সেকেন্ডারি লেভেলের। টারশিয়ারি কেয়ারের জন্য আরও অন্তত ৩০ হাজার শয্যা প্রয়োজন।
চিকিৎসার সঙ্গে রোগীর আস্থা ও বিশ্বাস পরস্পর সম্পর্কিত। রোগীরা অনেক কথা বলতে চায়, ডাক্তারের সামনে রোগীরা আরও বেশি সময় থাকতে চায়, কি রোগে আক্রান্ত হয়েছে সেটা জানতে চায়। স্বীকার করতে হবে এসব জায়গায় আমরা এখনো পিছিয়ে রয়েছি। আমরা চিকিৎসা খাতে যে ধরনের অভিযোগ শুনি তার বেশিরভাগই সৃষ্টি হয় মূলত রোগীদেরকে বুঝিয়ে বলতে না পারার কারণে। কিন্তু এই বিষয়টাকে উপস্থাপন করা হয় ভুল চিকিৎসা করা হয়েছে বলে। কিন্তু আসলে ভুল চিকিৎসা করা হয়নি। কোনো ডাক্তারই কখনো ভুল চিকিৎসা করতে চায় না। এখানে বরং ভুল বোঝাবুঝিটাই বড় কারণ হিসাবে কাজ করে।
একটি উপলক্ষ নিয়ে যখন একজন রোগী ডাক্তারের কাছে যান তখন কয়েক ধরনের অপশন থাকে। বিভিন্ন ধরনের রোগে একই লক্ষন থাকতে পারে। ধরি ৫০ বছর বয়সী একজন রোগী বুকে ব্যাথা নিয়ে ডাক্তারের কাছে আসলেন। রোগীর ইসিজি করে দেখা গেল তার একটি মাইল্ড হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। এক্ষেত্রে তাকে ডাক্তার অবজারভেশনে রাখতে পারেন আবার একটি প্রাইমারি এনজিওপ্লাস্টি করে ফেলতে পারেন। এখন এই দুটির যেকোনো একটি করতে গিয়ে যদি রোগী মারা যান তখন সেটাকে আমরা ভুল চিকিৎসা বলি। আমরা বলি এভাবে না করে ওভাবে করলে ঠিক ছিল। অথচ প্রকৃতপক্ষে এটা ভুল চিকিৎসা নয়।
আমরা ১৯৮০-এর দশক থেকে স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে যুক্ত। প্রথমে আমাদের ছিল ডায়গনস্টিক সেন্টার, এরপর জেনারেল হসপিটাল এবং এখন টারশিয়ারি কেয়ার হসপিটালও রয়েছে। আমাদের ক্যান্সার হসপিটাল ও কার্ডিয়াক হসপিটাল রয়েছে। আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ধাপে ধাপে উন্নতি করছে। তবে এই উন্নতিটা সারা দেশে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। ফলে এখানে বড় ধরনের ঘাটতি রয়ে গেছে।
মানুষ এখন বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পছন্দ করে। অথচ আগে মানুষ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাকে প্রাধান্য দিতো। আগে পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজে একটি সিট পাওয়ার জন্য চেষ্টা করতাম। কিন্তু এখন বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সুযোগ-সুবিধা অনেক উন্নত হয়েছে এবং মানুষ বেসরকারি হাসপাতালেই চিকিৎসা নিতে পছন্দ করছেন। বেসরকারি হাসপাতালের সেবার মান এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে মানুষের এক ধরনের আস্থা তৈরি হয়েছে। কিন্তু মানুষের এই আস্থা এবং ইচ্ছার সঙ্গে সাপোর্টিভভাবে অন্যান্য বিষয় গড়ে তোলা হয়নি এখনো।
বেসরকারি হাসপাতালের একটি মেজর অপারেশনসহ একজন রোগী যখন চিকিৎসা নেন তখন অন্তত ২ থেকে ৫ লক্ষ টাকা খরচ হয়ে যায়। সাধারণত বিভিন্ন কাজ বা উপলক্ষের জন্য আমাদের একটা পরিকল্পনা থাকে, বাজটে থাকে। যেমন বেড়ানো, খাওয়া দাওয়া, পোশাক কেনা, ঈদ বা উৎসবের জন্য আমাদের একটা বাজেট বা প্রস্তুতি থাকে। কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্যও যে একটি বাজেট থাকা প্রয়োজন সেটা আমরা চিন্তা করি না। অথচ স্বাস্থ্যের জন্য বাজেট রাখাটা ছিল সবথেকে জরুরি। কারণ অন্য কোনো কারণে বাজেট করে সেটা না করলেও কিছু যায় আসে না। কিন্তু অসুস্থ হলে চিকিৎসার কোনো বিকল্প নেই। যেহেতু স্বাস্থ্যের জন্য আমরা কোনো বাজেট রাখি না সেহেতু হঠাৎ বড় কোনো অসুস্থতায় বড় পরিমাণ অর্থ খরচ হয়ে গেলে সেই ধাক্কা আমাদের দুঃচিন্তাগ্রস্থ করে ফেলে।
একজন রোগীকে নিয়ে যখন তার পরিবারের সদস্যরা হাসপাতালে আসেন তখন তারা এক ধরনের মানসিক চাপের মধ্যে থাকেন। ডাক্তার যদি বলেন রোগীর সার্জারি প্রয়োজন তখন স্বজনদের সেটা ভালো লাগে না; এটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে ডাক্তার যদি বলেন রোগীর কিছু হয়নি বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন সে ক্ষেত্রে স্বজনরা খুশি হন। যখন রোগীর অপারেশন করা হয় তখন রোগী এবং তার পরিবারের জন্য সেটা হয় এক ধরনের সামাজিক, মানসিক এবং আর্থিক ইনজুরি। এই সব কিছু মিলিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ তৈরি হয়।
ডা. এ এম শামীম: প্রথমে আমাদেরকে স্বাস্থ্য সেবা বিষয়ের মূল জায়গাটা ধরতে হবে। স্বাস্থ্যের জন্যও মানুষের যে একটি বাজেট রাখা প্রয়োজন, সেটা বোঝাতে হবে। স্বাস্থ্য বীমার জন্য সরকারকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ডাক্তাররা ভালো চিকিৎসা এবং ভালো পরামর্শ দেন। কিন্তু আমাদের সংকটের জায়গাটি হচ্ছে, ডাক্তাররা চাইলেও রোগীদেরকে আরও বেশি সময়, আরও বেশি যত্ন নিতে পারেন না। এটা আমাদের জন্য এক ধরনের সীমাবদ্ধতা। বর্তমানে কার্ডিয়াক চিকিৎসায় বাংলাদেশ প্রথম সারিতেই রয়েছে। আমাদের সাধারণ চিকিৎসকরাও প্রথম শ্রেণীর। ক্যান্সারের চিকিৎসায় মানুষকে এক দুই বছর দেশের বাইরে থাকতে হয়। এখান থেকে উত্তরণের জন্য আমরা দেশে ক্যান্সার হাসপাতাল তৈরি করেছি। আমরা অনেক অর্থ বিনিয়োগ করেছি এবং ভালো মানের ডাক্তার ও টেকনোলজিস্ট পেয়েছি। ফলে ক্যান্সার চিকিৎসায় আমরা ভালো করছি। সামনে আরও হাসপাতাল হবে। তবে ২/৪টা হাসপাতাল দিয়ে এত রোগীর চিকিৎসা সেবা দেওয়া সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবা খাত এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে যত বেশি হতাশা প্রকাশ করি প্রকৃতপক্ষে পরিস্থিতি সেরকম হতাশাজনক নয়। আমরা সবাই দুই বেলা খাবার খাচ্ছি, পোশাক পরিধান করছি। আমাদের পদ্মা সেতু হয়েছে, মেট্রোরেল হয়েছে, সারাদেশে বিদ্যুতায়ন হয়েছে। তেমনি স্বাস্থ্য খাতেও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। তবে এ খাতে আরো মনোযোগের প্রয়োজন আছে।
ডা. এ এম শামীম: একজন ডাক্তার হয়তো ৫ থেকে ১৫ মিনিট সময় নিয়ে একজন রোগীকে দেখেন। এর মধ্যে অপারেশনের সময় কি হবে, অপারেশনের আগে কি হবে, পরে কি হবে, কত টাকা খরচ হবে, অপারেশনের ভালো এবং খারাপ কি হবে ইত্যাদি বিষয়গুলো একজন রোগীকে বোঝাতে গেলে অন্তত আধাঘন্টা থেকে এক ঘন্টা সময়ের প্রয়োজন। আমরা নতুন বছরে এই বিষয়টাকে একটি মেগা পরিকল্পনা হিসেবে গ্রহণ করছি। আমরা একটি কাউন্সিলর ডেস্ক করব। আমরা নার্সদেরকে প্রশিক্ষণ দিব, তরুণ মেডিকেল অফিসারদেরকে আমরা কনসালটেন্টের প্রশিক্ষণ দিব। আমাদের এখানে প্রতি মাসে দুই হাজার রোগী ভর্তি হয়। এই দুই হাজার রোগীকে আমরা কাউন্সেলিং করব। এরপর ধীরে ধীরে আমরা আউটডোর রোগীদের কাউন্সেলিংয়ের আওতায় নিয়ে আসবো।
আউটডোরে ডাক্তারের কাছে যখন একজন রোগী আসেন তখন তিনি অনেক টেস্ট রিপোর্ট এবং কাগজপত্র নিয়ে আসেন। তিনি নিজেও জানেন না তার কি হয়েছে। তিনি এর আগেও একাধিক ডাক্তার দেখিয়েছেন। তার কি কি পরীক্ষা হয়েছে সেটাও তিনি জানেন না। তখন ডাক্তার রোগীর সঙ্গে কথা বলে মোটামুটি যতটুকু সম্ভব জেনে নিয়ে প্রয়োজন মতো ইনভেস্টিগেশন দিয়ে দেন। যেহেতু রোগী সবকিছু পুরোপুরি জানেন না এবং ডাক্তার এতটা সময় নিয়ে সবকিছু তাকে অবহিত করতে পারেন না, ফলে রোগী এবং ডাক্তারের মধ্যে একটি কমিউনিকেশন গ্যাপ তৈরি হয়। আমরা ‘ল্যাবএইড এনালিটিক্স’ নামে নতুন একটি ল্যাবএইড হেলথ কেয়ার কোম্পানি করেছি। এখানে ল্যাবএইডের প্রায় ১০ লাখ রোগীর ডাটা রয়েছে। অর্থাৎ এখানে যদি একজন রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন তাহলে তার রোগের পুরনো সকল হিস্ট্রি ডাক্তার খুব সহজে আমাদের ডাটা সেন্টার থেকে দেখে নিতে পারবেন। আমরা যদি রোগীকে তার এই সামারি রেকর্ড বুঝিয়ে দিতে পারি তাহলে অসন্তুষ্টির ব্যাপারটি কমে যাবে।
আমি সকলের উদ্দেশ্যে বলবো আপনারা নিজেদের জন্য এক পেইজের একটি হেলথ সামারি করে নেন। এই হেলথ সামারীকে বলা হয় ইএমআর। ইএমআর-এর একটি ইউনিক নাম্বার রয়েছে। শুধুমাত্র এই ইউনিক নাম্বারটি নিয়ে যদি একজন ডাক্তারের কাছে বা কোনো মেডিকেল সেন্টারে যাওয়া হয় তাহলে খুব সহজেই রোগীর হেলথ কন্ডিশনের একটি আপডেটেড সামারি রেকর্ড দেওয়া সম্ভব হবে। ল্যাবএইড এই সেবাটি নিয়ে কাজ শুরু করেছে। হয়তো দু তিন বছর সময় লাগবে। তবে আমি বিশ্বাস করি এই বিষয়গুলো রোগীদের অসন্তুষ্টি ৯০ শতাংশ কমিয়ে দেবে।
ডা. এ এম শামীম: বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত হেলথ সার্ভিসের আওতায় একজন রোগী যখন হাসপাতালে যান তখন তার পকেট থেকে খরচ হয় ৩৫ শতাংশ অর্থ। অথচ আমাদের দেশে সেটি ছিল ৬০ শতাংশ। এখন আবার সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ শতাংশ। অর্থাৎ রোগীকে চিকিৎসার খরচের ৭০ শতাংশ বহন করতে হচ্ছে, যা কোনোভাবেই একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবস্থা নয়। এমনকি ভারতও এই দিক থেকে অনেক এগিয়ে গেছে।
ধরা যাক, একজন ব্যক্তি একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন। প্রতি মাসে ব্যক্তির বেতন থেকে ৩ শতাংশ স্বাস্থ্য বীমা হিসেবে কেটে রাখা হয়। এর বাইরে কোম্পানি অতিরিক্ত তিন শতাংশ ভর্তুকি দিতে পারে। দেখা গেল বছর শেষে ওই ব্যক্তি হেলথ ইন্সুরেন্সের জন্য মোট ৬ হাজার টাকা দিয়েছেন। বার্ষিক ৬০০০ টাকা খরচের এই ইন্সুরেন্সে ব্যক্তি, ব্যক্তির স্ত্রী বা সন্তান অসুস্থ হলে ৬ লক্ষ টাকা পর্যন্ত চিকিৎসা সুবিধা পাবেন। ইন্সুরেন্সধারীর বাবা-মায়ের ক্ষেত্রে এই পরিমাণ হবে ২৫ শতাংশ। এটাই হলো হেলথ ইন্সুরেন্সের একটি আন্তর্জাতিক মডেল।
আমরা জানি সরকার হেলথ ইন্সুরেন্স নিয়ে কাজ করছে। গ্রিন ডেল্টা ইন্সুরেন্সের সঙ্গে কাজ করছে সরকার। কয়েকটি পাইলট প্রজেক্টও করা হয়েছে। কিন্তু এসব প্রজেক্টের অগ্রগতি আমরা জানি না। তবে এখন আমরা বেসরকারি লেভেলেও হেলথ ইন্সুরেন্স চালুর চিন্তা করছি। আমরা প্রাথমিক পযায়ে এটি শুরু করার পর একটা সময় বড় আকারে কাজ শুরু করব। মানুষের চিকিৎসা পাওয়ার ও দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের দেশে এক কোটি মানুষ উচ্চ মধ্যবিত্তের মধ্যে পড়ে। যারা খুব সহজেই স্বাস্থ্য বীমা করে চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে পারেন। আমাদের দেশে প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ রয়েছেন, যাদেরকে রীতিমত ধনী বলা যায়। মধ্যবিত্ত মানুষ আছেন তিন কোটি এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ রয়েছেন ৪ কোটি।
মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য বছরে ৬০০০ টাকা স্বাস্থ্য বীমা করা কঠিন কিছু নয়। সরকার যদি এই বিষয়টিকে একটি মডেল হিসেবে নিয়ে প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপে কোনো প্রকল্প হাতে নেয় তবে সেটা অনেক কার্যকর হবে। ভারত এভাবেই এগিয়ে গেছে। ভারতে আরোগ্য শ্রী এবং আয়ুস্মান ভারত স্বাস্থ্য প্রজেক্ট নামে দুইটি প্রকল্পের প্রায় ৩০ শতাংশ ভারতীয় নাগরিককে স্বাস্থ্য বীমার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।
ডা. এ এম শামীম: বীমা কোম্পানিগুলোর উদ্দেশ্যই হল কমার্শিয়াল পেপার নিয়ে কাজ করা। উদাহরণস্বরূপ, আমি আমার প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রচুর এলসি করি। বছরে অন্তত ৫০ কোটি টাকার এলসি করতে হয় আমাদের। এর ১ শতাংশ খরচ হয় বীমার জন্য। অর্থাৎ বীমার জন্য আমার বার্ষিক খরচ ৫০ লক্ষ টাকা। কিন্তু গত ৩০ বছরে আমি কখনোই বীমা কোম্পানিতে কোনো ক্লেইম করেছি বলে আমার মনে পড়ে না। কিন্তু স্বাস্থ্য বীমার ক্ষেত্রে লাভের অঙ্ক এত বড় নয়। স্বাস্থ্য বীমায় মানুষ যে প্রিমিয়াম জমা দেন এবং মানুষের ক্লেইমের জন্য যে খরচ হয় দুইটির পরিমাণ প্রায় কাছাকাছি। ভারতে প্রথম ২৫ বছরে যারা স্বাস্থ্য বীমা নিয়ে কাজ করেছে তার মধ্যে ৮০ শতাংশ কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ কোম্পানিগুলোতে যে ক্লেইম হয়েছে তা প্রিমিয়াম থেকে বেশি। ফলে তারা বড় ধরনের লোকসানে পড়েছে। কিন্তু ভারত এখন একটি ভালো এস্টাবলিস্ট হয়েছে। এখন ভারতে যে ইন্সুরেন্স কোম্পানিগুলো স্বাস্থ্য সেবা খাতে কাজ করে তারা সফলভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সরকারের বা রেগুলেটরি কমিশনের উচিত যারা স্বাস্থ্য খাতে কাজ করছে তাদের নিয়ে একটি পাইলট প্রজেক্ট করা।
ডা. এ এম শামীম: বাংলাদেশ টারশিয়ারি লেভেলে একটি হাসপাতাল করতে গেলে প্রতি বেডের জন্য গড়ে তিন কোটি টাকা খরচ হয়। সেকেন্ডারি লেভেলে একটি হাসপাতাল করতে গেলে প্রতি বেডে ১ কোটি থেকে ৫০ লক্ষ টাকা খরচ হয়। এই মুহূর্তে আমাদের হাসপাতালগুলোতে দশ হাজার প্রথম শ্রেণীর বেড দরকার। আমরা নিজেরাই অনেক সময় রোগীদেরকে বেড দিতে পারি না বা যে ধরনের সেবা দেওয়া প্রয়োজন তা দিতে পারি না। এই মুহূর্তে আমাদের হাতে থাকা বেডের সংখ্যা ৬০০। অথচ আমাদের এই হাসপাতালে বিনিয়োগ রয়েছে দুই হাজার কোটি টাকা। আমরা যদি আরো ৫০০ বেড বাড়াতে চাই তাহলে আরো দুই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ দরকার, যা আমরা পাচ্ছি না।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো যদি পুঁজিবাজারে যায় হেলথ কেয়ারে ইনভেস্ট করার জন্য, এবং সম্মিলিতভাবে যদি একটি পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ গড়ে তোলা যায়, যেমনটি ভারতে হয়েছে, তাহলে একটি বড় পরিবর্তন নিয়ে আসা সম্ভব। ভারতের আরোগ্য শ্রী ও আয়ুস্মান ভারত প্রকল্পের আওতায় ৫০ কোটি মানুষের চিকিৎসা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যায় একজন রোগী চিকিৎসা নিতে এসে ডাক্তারের সিরিয়াল পাচ্ছেন না। অথবা একজন রোগী ৩০ মিনিট ডাক্তারের সময় চান কিন্তু পাচ্ছেন মাত্র ৫ মিনিট। চিকিৎসা খাতে বড় পরিবর্তন প্রয়োজন। একই সঙ্গে প্রয়োজন জনসচেতনতা। রাতারাতি এটা সম্ভব নয়।
একটি হিসেবে দেখা গেছে শুধুমাত্র চিকিৎসার জন্য কমপক্ষে ৪ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ থেকে বিদেশে চলে যায়। রোগীর সঙ্গে অন্য যারা বিদেশে যান তাদের খরচ, যাতায়াত খরচ সবকিছু মিলিয়ে অন্তত আরো ৪ বিলিয়ন ডলার বেশি খরচ হয়ে যায়। অর্থাৎ প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকা শুধুমাত্র চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। আমাদের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে এগুলো নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য সেবা খাত থেকে ২ বিলিয়ন ডলার, শিক্ষা খাত থেকে ২ বিলিয়ন ডলার, এভাবে আরও কয়েকটি খাত মিলিয়ে প্রতিবছর আমরা অনেক বড় একটি অঙ্ক দেশের বাইরে যাওয়া আটকাতে পারি।
ডা. এ এম শামীম: চিকিৎসা মানুষের একটি বেসিক চাহিদা। পাঁচটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে চিকিৎসা একটি। খাদ্য বস্ত্র এবং বাসস্থানে সংকট দেখা গেলেও মানুষ টিকে থাকতে পারে। কিন্তু একজন মানুষ চিকিৎসা ছাড়া টিকে থাকতে পারবেন না। সুতরাং চিকিৎসা খাত বা স্বাস্থ্য সেবা বিষয়টিকে আরো প্রাধান্য দেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকরা এগিয়ে না আসলে শুধু আমাদের পক্ষে এই ব্যবস্থার উন্নতি করা সম্ভব নয়।
ধরা যাক, আমরা বছরে ১০ লক্ষ মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিই। এর মধ্যে দুই একজন মানুষ অভিযোগ করেন কিন্তু দেখা যায় নেতিবাচক সেই প্রচারণাগুলোই ভাইরাল হয়। আর যারা সামাজিক মাধ্যমে এসে অভিযোগ করেন তাদের বেশিরভাগেরই লক্ষ্য থাকে টাকা-পয়সা অর্জন করা। অর্থাৎ তারা একটি অভিযোগ করে ভাইরাল হলে কর্তৃপক্ষকে বলে আমরা অভিযোগ উঠিয়ে নেব, কিন্তু বিনিময়ে ১০ লক্ষ টাকা দিতে হবে। কিন্তু এ ধরনের পরিস্থিতিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেন টাকা দেবে? এসব সমস্যার কারণে বড় বড় শিল্প গ্রুপগুলো এখন আর হাসপাতাল তৈরি করতে আগ্রহী হচ্ছে না। বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হতে কে চায়?
ডা. এ এম শামীম: আমাদের দেশে মানুষের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা রয়েছে। নেগেটিভ কথা বলার মধ্যে এক ধরনের আনন্দ খুঁজে পান অনেকে। আমরা এমনও দেখেছি একজন মানুষ মারা গেছেন তার তিন স্ত্রী ডেড বডি নিয়ে টানাটানি করছেন। আবার ধরা যাক, একজন ব্যক্তি আইসিইউতে রয়েছেন। তার এক সন্তান সুইডেন থেকে এসে বলছেন তিনি তার বাবাকে নিয়ে যেতে চান, বলেন- আমি ওনাকে বিদেশে নিয়ে যাবো, ওনার মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্ক খুলে দিন। আবার যে সন্তান ঢাকায় থাকেন, বাবাকে যিনি হাসপাতালে ভর্তি করেছেন, তিনি অক্সিজেন মাস্ক খুলতে নিষেধ করন। এ ধরনের বিভিন্ন ঘটনার সম্মুখীন হই আমরা। কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের ঘটনা এসবের তুলনায় খুবই নগণ্য।
দেশের অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তি বিদেশে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। দেশের বাইরে মারা গেলে কেউ কিছু বলতে পারে না। অথচ আমি নিজে দেখেছি আমাদের এখানে একজন বড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট তার হাত থেকে পরীক্ষার জন্য রক্ত নেওয়ার সময় তিনি হুলস্থুল কান্ড বাঁধিয়েছেন কারণ তার হাত থেকে নাকি রক্ত বেশি নেওয়া হয়ে গেছে। আমরা ৯৯৯ জন ব্যক্তিকে সেবা দিয়ে খুশি করতে পারি সেখানে একজন ব্যক্তি যদি অখুশী হন, তাহলে এই একজনের জন্য সবসময় টেনশনেও থাকতে হয়, মামলা হয়, কোর্টেও যেতে হয়। এটা আমাদের দেশে একটি খারাপ প্র্যাকটিস। ফলে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলো এখন আর স্বাস্থ্য সেবায় বিনিয়োগ করতে আসছেন না। সেই পুরোনো ল্যাবএইড, ইবনে সিনা, পপুলারই চলছে। এই পরিস্থিতি আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক।
ডা. এ এম শামীম: আমার মনে হয় আমাদের সকলের একজন ডাক্তার বা হেলথ কেয়ার নিয়ে কাজ করে এমন বন্ধু থাকা উচিত। এমন একজন ডাক্তার বন্ধু থাকা উচিত যাকে যেকোনো সময় প্রয়োজন হলে ফোন করা যাবে। দ্বিতীয়ত. আমরা যদি বছরে নিয়মিত একবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করি অর্থাৎ ডায়াবেটিস পরীক্ষা, ব্লাড প্রেসার চেক করি, যদি আমরা বছরে খুব বেশি হলে ৫০০০ টাকা খরচ করি তাহলে আমরা বড় চিকিৎসা ব্যয় থেকে বাঁচতে পারি। এতে আমরা নিজের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাবো এবং বড় কোনো রোগ দেখা দেওয়ার আগেই প্রাথমিক স্টেজে সেটা বুঝতে পারবো। অথচ আমাদের দেশে মানুষ তখনই হাসপাতালে আসেন যখন বুকে ব্যথা শুরু হয়। অথচ একটি স্ট্যান্টের দাম ৮০ হাজার টাকা বা এক লক্ষ টাকা। এভাবে এক ধাক্কায় তিন লক্ষ টাকা চলে যায়। সুতরাং তখন আর ব্যয় কমানোর সুযোগ থাকে না।
একজন ডাক্তার বন্ধু থাকা উচিত এ কারণে যে, আমরা কোন সমস্যায় কোন ডাক্তারের কাছে যাব সেটা তিনি পরামর্শ দিতে পারবেন। এর বাইরে আমাদের প্রত্যেকের উচিত একটি স্বাস্থ্য বীমা বা ব্যক্তিগত বাজেট করে ফেলা। স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা কেউ চিন্তা করি না কিন্তু আমার মনে হয় স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা করার সময় আমাদের এসেছে।
ডা. এ এম শামীম: বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি ধীরগতির প্রধান কারণ বিনিয়োগের স্বল্পতা। আমরা যখন ২০০২-০৩ সালের দিকে কার্ডিয়াক হাসপাতাল নির্মাণ করি ঠিক সে সময় স্কয়ার, ইউনাইটেড, অ্যাপোলোসহ অন্তত ২০টি প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য খাতে সেবা দিতে আসে। কিন্তু এরপর গত ১৫ বছরে তেমন বড় কোনো হাসপাতাল বেসরকারি খাতে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কারণ বিনিয়োগকারীরা ভয় পান, তারা সামাজিক অপবাদ কেন নেবেন? তারা মনে করেন, তারা অন্য ব্যবসা করতে পারেন— ইমপোর্ট এক্সপোর্ট এর ব্যবসা করতে পারেন, আড়তের ব্যবসা করতে পারেন। দিনশেষে সকলেই চান শান্তি। তাছাড়া এই ব্যবসা হিসাবে এই খাতে যে আহামরি কোনো লাভ রয়েছে, সেটাও নয়।
আমাদের সময় নিয়মকানুন অনেক বেশি ছিল। সবচেয়ে ভালো ছাত্রছাত্রী ডাক্তারি পড়তো। তখন আমরা ভাবতাম ভদ্রলোকরা ব্যবসা করেন না। আমরা ডাক্তারি পড়েছি কারণ আমরা চিন্তা করতাম সৎভাবে ইনকাম করতে গেলে তার জন্য ডাক্তারি পেশা ভালো। চিন্তা করতাম ডাক্তার হলে মানুষের সম্মান পাবো। কিন্তু এখন মানুষের চিন্তা-ভাবনা ডাক্তার বিরোধী হয়ে গেছে। দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেমেয়েগুলো সবাই এখন আর ডাক্তারি পেশাকে পছন্দ করে না। আমার নিজের ছেলে মেয়েরাও ডাক্তারি পড়েনি। এই অবস্থাকে অবশ্যই আমি বিপদজনক হিসেবে দেখি। আমেরিকায় ডাক্তারদের এমনভাবে দেখা হয় যেন ডাক্তার মানে ঈশ্বর। ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ার সমাজে ডাক্তারদের ইনকাম সর্বোচ্চ। সমাজে তাদের সর্বোচ্চ সম্মান রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা প্রফেশনালিও অনেক পিছিয়ে যাচ্ছি। আমাদের হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রেও ব্যবসা খারাপ নয়। তবে এখানে জবাবদিহিতা অনেক বেশি। এটিও ভালো। কিন্তু হয়রানি বেশি, যা কমাতে হবে।
ডা. এ এম শামীম: মানুষ তার বাসস্থান পরিবর্তন করে। আজ যারা ঢাকায় থাকেন ২০ বছর আগে তারা হয়তো ময়মনসিংহ, খুলনা কিংবা অন্য কোনো বিভাগে থাকতেন। ৪০ বছর আগে যারা ঢাকায় বসবাস করতেন তারা হয়তো অনেকে এখন আমেরিকায়। যশোরের মানুষ ঢাকাতে আসেন, ঢাকার মানুষ কলকাতায় যান, কলকাতার মানুষ বেঙ্গালুরুতে যান আবার বেঙ্গালুরুর মানুষকে আমি চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে যেতে দেখেছি। তেমনি মানুষ চিকিৎসার জন্য অন্য জায়গায় কেন যান? আমার কাছে মনে হয় মানুষ মনে করে দেশের থেকে বিদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক ভালো। বাংলাদেশ থেকে অনেক মানুষ ভারতে চিকিৎসা নিতে যান। কিন্তু ভারতে ব্যাপক সংখ্যক ভুল চিকিৎসা, অনেক খরচ এবং খারাপ ব্যবহারের মতো ঘটনা আমার নিজের চোখে দেখেছি।
বাংলাদেশের অনেক বেসরকারি হাসপাতালের খরচ ল্যাবএইড-এর থেকে তিনগুণ বেশি। থাইল্যান্ডের চিকিৎসা খরচ বাংলাদেশ থেকে অন্তত ছয় গুণ বেশি। মাউন্ট এলিজাবেথ বা অন্যান্য যে সকল হাসপাতালের কথা আমরা শুনি সেখানে খরচ আমাদের দেশের থেকে অন্তত ২০গুণ বেশি। আমরা একটি কার্ডিয়াক সার্জারিতে ৪ লক্ষ টাকা নেই, তারা নেয় এক কোটি টাকা।
বাংলাদেশে প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর মধ্যেও হাসপাতাল ভেদে ব্যয়ের অনেক পার্থক্য রয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষেরা এখনো ইবনে সিনা, ইসলামী ব্যাংক হসপিটাল বা এই ধরনের অন্যান্য হসপিটালে স্বাস্থ্য সেবা নেন। এসব জায়গায় অ্যাপেন্ডিক্স এর একটি সার্জারি জন্য তারা পনের হাজার টাকা নেয়। ঢাকার বড় হাসপাতালে এই একই সার্জারির জন্য নেয় এক থেকে দেড় লক্ষ টাকা। অনেক মানুষ মনে করেন বড় হাসপাতাল কিংবা বেশি খরচের হাসপাতালে চিকিৎসা বেশি ভালো। তারা বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়াটাকে প্রেস্টিজ মনে করেন। অনেক মানুষ ব্যয় করে আনন্দ পান।
প্রথম বিষয়টি হলো ভালো চিকিৎসা হওয়া দরকার। সর্বপ্রথম এটি নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, রোগীর সেটিসফেকশন দরকার। রোগী যেন জানেন যে তার কি হয়েছে এবং ভবিষ্যতে কি হতে পারে। এরপর আসবে ব্যয়ের ব্যাপারটি।
ডা. এ এম শামীম: আমাদের একটি পত্রিকা আছে 'সুখে অসুখে'। সেখানে আমরা স্বাস্থ্য নিয়ে নানা ধরনের পরামর্শ দিই। এটিকে গুছিয়ে আরো বড় পরিসরে করতে চাই। সামাজিক ক্যাম্পেইনের মতো এটিকে এগিয়ে নিতে হবে। অনেক এনজিও এসব বিষয় নিয়ে কাজ করে। আমরা হেলথ কেয়ার বলতে শুধুমাত্র চিকিৎসা মনে করি। কিন্তু শুধুমাত্র চিকিৎসা নয় নিজেকে ঠিক রাখাটাও হেলথ কেয়ার। এসব ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আরো জোরদার ভূমিকা রাখতে পারে।
ডা. এ এম শামীম: চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি বেসরকারি হাসপাতালে একটি সিজারিয়ান সার্জারির জন্য মাত্র আড়াই হাজার টাকা নিতে দেখেছি। ঢাকার অনেক বড় হাসপাতালে যেখানে তারা ২ লক্ষ টাকার বেশি নেয়। রাজশাহীতে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে ৩ হাজার টাকায় অ্যাপেন্ডিক্স সার্জারি করতে দেখেছি। ঢাকার বড় হাসপাতালে যেখানে খরচ ১ লক্ষ টাকার বেশি। সুতরাং কম খরচ প্রাইভেট হাসপাতালের চিকিৎসা এগিয়ে যাচ্ছে সমগ্র বাংলাদেশ।
বড় শহরে বড় বড় হাসপাতালগুলোতে খরচ বেশি হলেও বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বা উপজেলা পর্যায়ে অনেক প্রাইভেট ক্লিনিকে খুব স্বল্প খরচে রোগীরা চিকিৎসা নিতে পারেন। কিছু কিছু ঘটনা আমরা পত্রপত্রিকাতে দেখেছি যেখানে ভুয়া চিকিৎসক বা ভুয়া চিকিৎসার ব্যাপারে সংবাদ হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা ঘটে এবং এগুলো দুর্ঘটনা। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় হেলথ ডাইরেক্টরের যারা রয়েছেন তাদের উচিত বেসরকারি হসপিটালের জন্য একটি আলাদা সেক্রেটারিয়েট করে আমাদেরকে মনিটরিংয়ের আওতায় নিয়ে আসা। ভারতে প্রত্যেকটি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সব সুবিধা, সরঞ্জাম এবং সেকশন আছে কিনা তা মনিটর করা হয়।
আমরা যদি আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং সেবাকে একটি স্ট্যান্ডার্ড-এর মধ্যে আনতে পারি তাহলে খুব অল্প খরচেও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দেওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের সব হাসপাতালে ল্যাবএইড-এর মতো এত উন্নত সেবা, এত প্রশিক্ষিত লোকজন এবং এতো টেকনোলজি সমৃদ্ধ নয়। সুতরাং সেবার মানের ভিত্তিতে খরচ কম বেশি হয়। তবে সকল প্রাইভেট হাসপাতালগুলোকে একটি সমন্বিত মনিটরিং এবং ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসা প্রয়োজন। একটি এক্রিডিটেশন যেমন, এনএবিএইচ বা জেসিআই এর মতো দেশীয় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এটি করা সম্ভব।
ডা. এ এম শামীম: গণমাধ্যমের কাছে আমাদের চাওয়া, অবশ্যই আপনারা আমাদের ভালো দিকগুলো মানুষের কাছে তুলে ধরেন। আমাদের ভালো দিকগুলো বলেন। সবাই যদি বেসরকারি চিকিৎসা খাতের প্রতি নিরুৎসাহিত হয়ে যায় তাহলে এই সেক্টরটি দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। এটি অবশ্যই বাংলাদেশের চিকিৎসা খাতের জন্য এবং সমাজের জন্য একটি বড় ক্ষতি। গণমাধ্যমের প্রতি আমরা আহ্বান জানাবো আপনারা ডাক্তারি প্রফেশনটাকে সাপোর্ট করেন। বেসরকারি চিকিৎসা খাত নষ্ট হলে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা আরো খারাপ হবে। একজন ডাক্তার বা একজন নার্স কখনোই জেনেশুনে একজন রোগীর ক্ষতি করেন না। গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানাবো আপনারা আমাদের স্বাস্থ্য খাতে ডাক্তারদের সংগ্রাম এবং তাদের সফলতার গল্প বলেন। আমরা বাংলাদেশে দুইটি সফল লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করেছিলাম। এন্টি মিডিয়া ক্যাম্পেইনের ফলে আমরা এটি বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি। এখন টোটাল লিভার ট্রান্সপ্লান্ট সিস্টেম বাংলাদেশে বন্ধ। বাংলাদেশি রোগীদের লিভার ট্রান্সপ্লান্ট এর সমস্ত চিকিৎসা হয় ভারতের। সেখানে একটি লিভার ট্রান্সপ্লান্ট এর জন্য খরচ হয় ১ কোটি টাকা। আমরা করেছিলাম ১০ লক্ষ টাকায়। এখানে ক্ষতিটা কার হয়েছে? ক্ষতি হয়েছে দেশের এবং দেশের মানুষের।