যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ। দেশের প্রতিটি কোণে অপুষ্টি, অনুপুষ্টিতে ভুগছে সব বয়সী মানুষ। গ্রাম কি শহর সবখানে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার ছিল বেশি। টিকা প্রয়োগের হার নগণ্য। নেই স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো। ৫০ বছর পর সেসব এখন ইতিহাস। বাংলাদেশ এখন টিকা কার্যক্রমে বিশ্বের মডেল। মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হারে নিম্নমুখিতার গতি। বেড়েছে গড় আয়ু। রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল, গড়ে উঠেছে চিকিৎসা অবকাঠামো।
বর্তমানে সারা দেশে সাড়ে ১৪ হাজারেরও বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু আছে। এগুলোর মাধ্যমে মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যসেবাসহ ৩০টি অতি প্রয়োজনীয় ওষুধ বিনামূল্যে প্রদান করা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় তিন হাজার ক্লিনিকে স্কিলড বার্থ অ্যাটেনডেন্স সেবা প্রদান করা হচ্ছে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অধীন ৩ হাজার ২৯০টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র/পরিবার পরিকল্পনা ক্লিনিক থেকে মা, শিশু ও বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনাসেবা প্রদান করা হচ্ছে। এর মধ্যে ২ হাজার ২০০টি কেন্দ্র থেকে সার্বক্ষণিক স্বাভাবিক প্রসবসেবা প্রদান করা হচ্ছে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবায় সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি খাত, বিভিন্ন এনজিও ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। সরকারি খাতে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় নীতি প্রণয়ন, পরিকল্পনা এবং ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে।
বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যসেবা খাতে বড় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ল্যাবএইড অন্যতম। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছে এই গ্রুপ। গত তিন দশকেরও বেশি সময়ে সারা দেশে রোগ নির্ণয় ও বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবার প্রসার করেছে গ্রুপটি। আগামী অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে বেসরকারি চিকিৎসা সেবা খাতে বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন ল্যাবএইডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকডা. এএম শামীম
দেশেরস্বাস্থ্য খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য।কিউরেটিভকেয়ার বা চিকিৎসায় বেসরকারির আকার বড়।বেসরকারিবিনিয়োগকে আরো আগ্রহী করতে আসন্ন জাতীয় বাজেটে আপনার কী প্রত্যাশা রয়েছে?
প্রথমত স্বাস্থ্য খাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।যেমনটি করা হচ্ছে পোশাক শিল্প ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে।সরকারি পরিসংখ্যান বা পত্রপত্রিকায় দেখি,শুধু চিকিৎসা সেবা বাবদ বছরে ৪-৫ বিলিয়ন ডলার বিদেশে চলে যায়।এর সঙ্গে সেখানে কেনাকাটা বা মার্কেটিং,যাতায়াত ভাড়া,থাকা-খাওয়া ও বিবিধ খরচ মিলিয়ে তা ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার হবে।এভাবে একটা বড় অংকে বৈদেশিক মুদ্রা বেরিয়ে যায়।আমাদের এমন ব্যবস্থা করতে হবে,যাতে দেশের টাকা দেশে রাখতে পারি।দেশের স্বাস্থ্য খাত ভালো হলে এই টাকা দেশের বাইরে যাওয়া বন্ধ হবে।সাধারণ মানুষ ভালো সেবা পাবে।
গত দুই বছরে স্বাস্থ্য খাতে খরচ বেড়েছে।কাঁচামাল আমদানিতে ফার্মাসিউটিক্যালসের খরচ সবচেয়ে বেশি।তাছাড়া ৮৪ টাকার ডলার এখন ১২০-১২২ টাকায় কিনতে হয়।প্যাথলজির জিনিসপত্রও মূলত আমদানি করতে হয়।ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের খরচও বেড়েছে।ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধি পেয়েছে।৮ শতাংশ সুদহার এখন ১৪ শতাংশ হয়ে গেছে।এতে করে আমাদের মোট খরচের ওপরআরো১০ শতাংশ যুক্ত হয়েছে।এত কিছুর পরও ওষুধ ও স্বাস্থ্য খাতের অন্যান্য সেবার দামও সেভাবে বাড়েনি।এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নতুন বিনিয়োগ কঠিন।স্বাস্থ্য খাতের স্থায়িত্ব আরো কীভাবে করা যায় তা এখন চিন্তার বিষয়।
স্বাস্থ্য খাতেবিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশার প্রতিফলনকিআগেরবাজেটগুলোয় আপনি দেখতে পেয়েছেন?
জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ অন্যান্য দেশের তুলনায় কম।ভারতেও সাড়ে ৭ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়।কিন্তু বাংলাদেশে তা মাত্র ৫ শতাংশ।জনপ্রতি হিসাবে সেটা হয় মাত্র ২ হাজার টাকা।মানুষের স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়ের ৭০ শতাংশই আসে তাদের পকেট থেকে।আমরা দেখেছি আগের বাজেটগুলো স্বাস্থ্য খাতের বাজেট অপ্রতুল।কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে সেই কম বরাদ্দও যথাযথ ব্যবহার করা হয় না।মেশিন পড়ে থাকে,ঠিকঠাক সংরক্ষণ হয় না।
আর একটা বিষয় আমরা লক্ষ্য করেছি,যে খাতে বেশি বিনিয়োগ দরকার সে খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না।আমি যদি ক্যাপিটাল মেশিনারি ক্রয় করি,তাহলে আয়কর অগ্রিম ৫ শতাংশ দিতে হয়।এগুলো আনতে ট্যাক্স-ভ্যাটসহ আমাদের সর্বমোট ৩৩ শতাংশ চলে যায়।যেটা গার্মেন্টসহ অন্যান্য সেক্টরে অনেক কম।এছাড়া স্পেয়ার পার্টস,যেমন একটা সিটিস্ক্যান মেশিনের একটা টিউব আমরা ১২ হাজার ডলার দিয়ে আমদানি করি।এরপেছনেআরোপ্রায় ৪৯ শতাংশ ব্যয় হয়ে যায়।স্পেয়ার পার্টসের ওপর করের বোঝা কমাতে হবে।আগাম ৫ শতাংশের যে কর রয়েছে তা তুলে দেয়া উচিত।অন্যান্য অগ্রাধিকার খাতে কর রিটার্ন দুই মাস পরে দেয়া যায়।সেক্ষেত্রে ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জ রাখলেও স্বাস্থ্য সেবা খাতের জন্য ৪ শতাংশ রাখা হয়।ব্যাংকগুলো স্বাস্থ্যসেবা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় অন্যান্য খাতে বেশি ঋণ দেয়।মোট ব্যাংক ঋণেরহয়তো৫ শতাংশও স্বাস্থ্য খাতে আসে না।এটা ৭ বা৮শতাংশ করা উচিত।একটি বিলাসবহুল গাড়ির জন্য ঋণের প্রয়োজনীয়তার চেয়ে আরটিপিসিআরের রিএজেন্ট বা ফার্মাসিউটিক্যালসের কাঁচামালআরোবেশি জরুরি।দেশী ওষুধের মান ভালো হলেও দাম অন্যান্য দেশের তুলনায় কম।সব বিনিয়োগকারী হেলথকেয়ারে আসে না।কেননা এখানে এক্সপার্টাইজ লাগে।গার্মেন্টস বা টেক্সটাইলে যদি পাঁচ বা দশ হাজার বিনিয়োগকারী থাকেন,অন্যদিকে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতে প্রকৃত উদ্যোক্তা ১০-২০ জন।স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত।করপোরেট কর হ্রাস করা দরকার।
কিউরেটিভকেয়ার বা চিকিৎসা সেবার সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে দক্ষ জনশক্তির অভাব।সংকটনিরসনে কী কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে?এতেবাজেটের কি অবদান থাকতে পারে?
অন্যান্য দেশে ডাক্তার যদি ১০০ থাকেন,তবে নার্স থাকেন ৩০০ জন,আর টেকনোলজিস্ট থাকেন ৮০০।আমাদের দেশে এই বিষয়টা সম্পূর্ণ বিপরীত।আমাদের নার্সিং কলেজ,মেডিকেল টেকনোলজি কলেজ আছে।তবে এখানে পড়াশোনায় খরচ বেশি।এসব প্রতিষ্ঠানকে কর সুবিধার বাইরে বইপত্র দেয়া যেতে পারে।অথবা পাঁচ বছর কর মওকুফ করা যেতে পারে।এই শিক্ষার্থীরাই যদি সরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করত,তাহলে তাদের পেছনে সরকারের খরচ বাড়ত।একজন ডাক্তারেরপেছনে পাঁচ বছরে সরকারের ১৪-১৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়।নার্সেরপেছনে তিন লাখ টাকা।আর আমরা বেসরকারি পর্যায়ে দক্ষ নার্স তৈরি করলেও এক্ষেত্রে কর রেয়াত দেয়া হচ্ছে না।আমি মনে করি, নার্স-মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পড়াশোনার জন্য বাজেটে একটা বরাদ্দ রাখা উচিত।এতে সরকার পরোক্ষভাবে উপকৃত হবে।বিদেশেও বাংলাদেশী নার্সদের প্রচুর চাহিদা রয়েছে।আমাদের জনশক্তি রফতানির এটা একটা বড় উৎস হতে পারে।
মোটদেশজ উৎপাদনের(জিডিপি)অনুপাতেযেসব খাতে কম ব্যয় করা হয় তার মধ্যে স্বাস্থ্য খাত একটি।বার্ষিকউন্নয়ন কর্মসূচিতে(এডিপি)স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ সন্তোষজনক কিনা?এইদুই বিষয়ে আপনার মতামত কি?
স্বাস্থ্য খাতে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ৫শতাংশের কম,আর জিডিপিতে১শতাংশের কম।এটা বাড়ানোর পাশাপাশি বেসরকারি খাতের দিকে নজর দেয়ার সময় এসেছে।স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে(পিপিপি)আসা উচিত।পিপিপির মাধ্যমে সারা দেশে ১৫-২০টি হাসপাতাল,যেগুলো সরকার ঠিকঠাকমতো চালাতে পারছে না,সেগুলো পরিচালনা করা যেতে পারে।যেমন কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতাল,মুক্তিযোদ্ধা হাসপাতাল,রেলওয়ে হাসপাতালসহ এমন অনেক হাসপাতাল আছে যেগুলো যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালনার উদ্যোগ নিতে পারে সরকার।এতে মানুষের উপকার হবে।
সরকার-বেসরকারিঅংশীদারত্ব কীভাবে করা যায়?এবিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ জানতে চাই।
এ বিষয়ে যৌথ বিনিয়োগ হওয়া উচিত।ভারতে এমনটি রয়েছে।সেখানে অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বেসরকারি উদ্যোক্তারা জড়িত।সরকারি জনশক্তিতে যারা আছেন,তারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারেন।বেসরকারি কর্মী যারা আছেন,সংকটকালীন সময় তারা সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করবেন।ভারতের আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পে ১০ কোটি পরিবারের ৫০ কোটি মানুষকে সেবা দিচ্ছে।বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অব্যবহৃত অংশ সরকার ব্যবহার করে ন্যূনতম খরচে।এই ধারা ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।বাংলাদেশে কিডনি ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ডায়ালাইসিস সেন্টার হয়েছে।তবে সেই ব্যবস্থাপনা অতটা সফলতা পায়নি।ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকারি কিছু কর্মচারী সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ থাকায়ও ব্যর্থতা প্রভাবিত হয়েছে।যেভাবে চালানোর কথা ছিল সেভাবে চালাতে পারেনি।চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডায়ালাইসিস সেন্টারও ব্যর্থ হয়েছে।সেখানেও অনেক সমস্যা।ওখানে প্রতিষ্ঠানের কোনো দোষনেই।সমস্যা পরিচালনার মূলনীতিতে।আয়ুষ্মান ভারতের পুরো ব্যাপারটা খেয়াল করলে দেখা যায়,একটা জনবহুল দেশে যেখানে বাংলাদেশের চেয়েও বেশি গরিব মানুষ রয়েছে সেখানে কীভাবে ৫০ কোটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব এক প্রকল্প নিয়েছে।
চিকিৎসাগ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয়(আউটঅব পকেট পেমেন্ট)৭০শতাংশের বেশি।বিশ্বেরযে দেশগুলোয় এই আউট অব পকেট পেমেন্ট বেশি তার মধ্যে শীর্ষে বাংলাদেশ।ব্যক্তিরনিজস্ব এই ব্যয় কমাতে বাজেট কি ভূমিকা রাখতে পারে?
আউট অব পকেট পেমেন্ট কমাতে হলে একটা সমন্বিত প্রয়াস থাকতে হবে।প্রথম জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে ইলেকট্রনিক মেডিক্যাল রেকর্ড(ইএমআর)তৈরি করতে হবে।এটা খুব সহজেই করা যাবে।এর মাধ্যমে একজন রোগী সরকারি বা বেসরকারি যে হাসপাতালেই যাক,তার রোগের ইতিহাস পাওয়া যাবে।তার সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা জানা যাবে।রোগী চিকিৎসার জন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানে গেলে ডাক্তার আগে পরীক্ষা করেন,নতুন মেডিকেল ইতিহাস নেন।এতে কিছু বিষয় বাদ পড়ে যায়।এতে ডুপ্লিকেশন অব ইনভেস্টিগেশন(রোগ নির্ণয়ে একই পরীক্ষা বারবার)হতে পারে।অথচ ইএমআর থাকলে ওই রেকর্ড দেখে চিকিৎসক কিন্তু আগের চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেও নিতে পারেন।একই সঙ্গে টেলিফোনের মাধ্যমে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়।একসঙ্গে অনলাইন কনফারেন্স,জুমে রোগীর আগের চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলা যাবে।রোগীরআগেরস্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলা যাবে।এভাবে একটা রেফারেল সিস্টেম চালু হবে।
এটা করতে শুরুতে একটা পাইলট প্রকল্প করা যেতে পারে।আমাদেরমতো১০টা প্রতিষ্ঠানকে বাজেট দিয়ে এক হাজার করে রোগী দেয়া হলে আমরা ব্যয় কমানোর ক্ষেত্রে কার্যকর উদাহরণ দেখাতে পারব।ইএমআর থাকলে এখন ডেঙ্গুর পরামর্শ নির্দিষ্ট রোগীকে দেয়া যাবে।স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য কিছু নির্দেশিকা দেয়া হবে।স্বাস্থ্যসেবা মানেই চিকিৎসা নয়।আর হাসপাতাল মানেই শুধু সেবা তা নয়।
স্বাস্থ্যবীমানিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আলোচনা চলছে।সুনির্দিষ্টকোন পরিকল্পনার মাধ্যমে একটি সর্বজনীন স্বাস্থ্য বীমা চালু করা যায়?স্বাস্থ্যসেবাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কীভাবে এর আওতায় আনা যায়?
স্বাস্থ্যবীমার কথা আমরা অনেক দিন যাবত বলে এসেছি।যুক্তরাষ্ট্র,এমনকি ভারতেও এখন স্বাস্থ্যবীমার বিষয়টি অত্যন্ত শক্তিশালী।সরকারিভাবে সেখানে প্রতিষ্ঠিত বীমা কোম্পানিগুলোকে পাইলট প্রজেক্ট দেয়া হচ্ছে।ভারতে স্বাস্থ্যবীমা শুরু হয় ১৯৯০ সালের শুরুতে।তবে বাস্তবে তারা কাজ শুরু করে ২০১৫ সালে।২৫বছর ধরে ওরা পরীক্ষা-নিরীক্ষাই করেছে।এখন শুধু স্বাস্থ্যবীমার জন্যই ভারতে ২০-৩০টি কোম্পানি হয়ে গেছে।তারা এখন প্রিমিয়াম নিয়ে সার্ভিস দিয়ে বছর শেষে কিছু মুনাফাও করছে।বাংলাদেশে বিষয়টিকে স্বতন্ত্রভাবে গুরুত্ব দিয়ে হেলথ ইন্স্যুরেন্সের অনুমতিদেয়া জরুরি।এরই মধ্যে যারা হেলথ কেয়ারে আছেন তাদের যুক্ত করে পাঁচ বছরের একটা পরিকল্পনা করাহলেইতা সম্ভব হবে।
শুধু স্বাস্থ্যবীমার জন্য যদি ৫-১০টা কোম্পানিকে নিয়ে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পরীক্ষামূলক কাজ শুরু করা যায়।এটা বাস্তবায়ন করা গেলে সরকারের ওপর চাপ কমে যাবে।তখন বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের ওপর জবাবদিহিতাও আসবে।আর সাধারণ মানুষ যদি বছরে একটা ন্যূনতম খরচ দিয়ে একটা বড় খরচের হাত থেকে বাঁচে,তাহলে তারাও এদিকে আসবে।
নতুনস্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করতে বাজেটে কী কী বিষয় থাকা উচিত বলে মনে করেন?
প্রথমত বাজেটে একটা বরাদ্দ থাকা উচিত,বিনিয়োগের জন্য সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক মিলে একটা নির্দিষ্ট অংকের ঋণ প্রদান করবে।গত ১০ বছরে স্বাস্থ্য খাতে ভালো উদ্যোক্তা আসেনি।একই কথা ফার্মাসিউটিক্যালসের জন্যও সত্য।ফলে যারা ভালো করছে তাদেরসঙ্গে আরো২০টা ভালো প্রতিষ্ঠান করা যায় কিনা তা ভাবতে হবে।বর্তমানে সুদের হার ১৪ শতাংশে চলে গেছে।এটা আরো কমিয়ে আনার পরিকল্পনা করতে হবে।তিন থেকে পাঁচ বছরের একটা সত্যিকার কর রেওয়াত দেয়া যায় কিনা সেটা ভেবে দেখতে হবে।পাঁচ থেকে দশ বছরের সমন্বিত পরিকল্পনা করা যেতে পারে।আবার পরিকল্পনা করলেই হবে না,তা বাস্তবায়নও করতে হবে।
বেসরকারিভাবেদেশে রোগ নির্ণয় কেন্দ্র,হাসপাতাল,মেডিকেলকলেজ,ইনস্টিটিউটেরসংখ্যা বাড়ছে।একইসঙ্গে চিকিৎসায় অবহেলা,দায়িত্বশীলতারঅভাব ও অন্যায্য মুনাফা নেয়ার কথা শোনা যায়।এক্ষেত্রেপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কীভাবে পরিপূর্ণভাবে শৃঙ্খলায় আনা যায়?
স্বাস্থ্য খাতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে নানা ধরনের ক্যাটাগরি করা উচিত।যেমন এ,বি,সি,ইত্যাদি।এটা শুধু শয্যাসংখ্যার ওপর নির্ভর করে হবে নাবরংডাক্তার,নার্স,পূর্ণকালীন কর্মী,অ্যাক্রিডিটেশন,গুণগত মান নিয়ন্ত্রণে প্রক্রিয়া,আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি,চিকিৎসা সাফল্যের হার এসব বিবেচনায় নিয়ে ক্যাটাগরি করতে হবে।এরপরিপ্রেক্ষিতে তাদের ফি নির্ধারণ করা হবে।
আবারকোনোঅভিযোগ এলেই সেটা নিয়ে হইচই করা ঠিক না।হয়তো এক রোগী অভিযোগ করেছে,সেখানে শুরুতেই বলা যাবে না ভুল চিকিৎসা।একজন রোগী বুকে ব্যথা নিয়ে এলে তাকে প্রাইমারি এনজিওপ্লাস্টি দেবে নাকি কনর্জাভেটরিদেবে,না অস্ত্রোপচার করা হবে,তা চিকিৎসকই নির্ধারণ করেন।এখন প্রাইমারি এনজিওপ্লাস্টি দিলে তো আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ৩-৫ শতাংশ মারা যায়।যে ৯৭ শতাংশ বাঁচে তা গল্পে আসে না।আসে মৃত্যুর বিষয়টি।তবে ডাক্তাররা যদি আরো একটু বেশি সময় নিয়ে কাউন্সেলিং করান তাহলে অনেক অভিযোগই থাকে না।সব খাতেই অস্থিরতা আছে।তবে স্বাস্থ্য খাতের অস্থিরতার প্রকাশ বেশি।হাসপাতালে অপারেশনের সময় কেউ মারা গেছে,এটা নিয়ে মিছিল হয়।কিন্তু কেউ যদি ব্যাংক থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা মেরে দেয় কিংবা সে যদি এক লাখ লোকে অন্তত এক বছরের খাবার কেড়ে নেয়,তা নিয়ে মিছিল হয় না।স্বাস্থ্যের ব্যাপারে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল(বিএমডিসি)চিকিৎসককে জবাবদিহি করবে।যে চিকিৎসক নন,তিনি কীভাবে বলবেন এটা ভুল চিকিৎসা না সঠিক চিকিৎসা ছিল।ভুল চিকিৎসা বলতে হলেও তো তাকে চিকিৎসক হতে হবে।স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানকে যদি স্বাধীনতা না দেয়া হয়,তারা কাজ করতে পারবে না।এখন অনেক রোগীই ডাক্তারা ফিরিয়ে দেন,চিন্তা করেন এমন রোগীকে চিকিৎসা দিলে যদি ক্ষতি হয়।এই বিষয়টি শুরু হয়েছে।এটাআরোক্ষতিকর।যেমন জরুরি বিভাগে চারজন রোগীকে চিকিৎসা দিলে তিনজন বাঁচে,একজন হয়তো মারা যায়।এখন কোনো প্রতিষ্ঠান যদি ঝুঁকি এড়াতে ওই চারজনকে অন্যত্র পাঠাতে চায় তাহলে ক্ষতি আরো বেশি হবে।
এখনোবিভিন্ন শাখায় বিশেষায়িত চিকিৎসা বাংলাদেশে প্রস্ফুটিত হয়নি।এরসংকট ও সীমাবদ্ধতা কোথায়?সুনির্দিষ্টভাবেজাতীয় বাজেটে এজন্য কি নীতি গ্রহণ করা উচিত?
ক্যান্সার,কিডনি,নিউরো,অর্থোপেডিক,চক্ষু এসব বিষয়ে এখনো রোগীরা বিদেশে যায়।বাজেটে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক(এডিবি),ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক(আইডিবি),আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল(আইএমএফ)ঋণ দেয়।বাজেটে যদি বলা হয় সুনির্দিষ্ট পাঁচটি রোগের জন্য হাসপাতাল হবেএবংসেসব রোগে ছাড় দেয়া হবে,তাহলে দৃশ্যমান পরিবর্তন আসবে।এক হাজার বা আড়াই হাজার বেডের যদি কিডনি,নেফ্রোলজি বা অর্থোপেডিক,ট্রমা হাসপাতাল হয় তাহলে বাংলাদেশে বছরে ৫ হাজার কোটি টাকা বাঁচে।ওনারা যে ঋণ দেবেন,সেই টাকা এক বছরেই দেশের আয় হবে।
আমরা চাই আমাদের কাজের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা কমানো হোক।আমাদের কাজ করে দিতে হবে না,আমাদের কাজ আমরাই করব,সরকার কেবল কাজের সুযোগটা বাড়িয়ে দিক।ধরা যাক পাঁচটা গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ আমদানি করা হয়,সেগুলোর কাঁচামাল আমদানি সহজ করে দেয়া হোক,দেশেই সেগুলো উৎপাদন করা যাবে।এতে সহজে মানুষের প্রয়োজন যেমন মিটবে,তেমনি বৈদেশিক মুদ্রারও সাশ্রয় হবে।
এপিআই বা কাঁচামালে কতগুলো ইন্ডাস্ট্রি হচ্ছে।এক একটি ইন্ডাস্ট্রির জন্য হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ লাগবে।মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় এপিআই পার্কে প্রায় ২০০ প্লট দেয়া হয়েছে।কিন্তু পাঁচটার বেশি কোম্পানি যেখানে যায়নি।এটা তাদের দোষ নয়।এর জন্য আসলে একটা নীতিমালা লাগবে এবং ২০ বছর এদেরকে টানতে হবে।আমরা বছরে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার এপিআই আমদানি করি।এই কারখানাগুলো চালু করা গেলে ২০৩৫ সালের পর থেকে আর আমদানি করতে হবে না।
বিভিন্নদেশে মেডিকেল বর্জ্য নিয়ে বহুমুখী পদক্ষেপ দেখা যায়।বাংলাদেশেরবাজেটে মেডিকেল বর্জ্য নিয়ে কি সুবিধার পরামর্শ রয়েছে?যাতেপরিবেশ রক্ষা,সংক্রমণরোধ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যায়?
আমি গত তিন বছর ধরে বাজেটের আগে মেডিকেল বর্জ্য নিয়ে অনেক কথা বলছি।কিন্তু দুঃখজনক,পরিস্থিতি তিন বছর আগে যা ছিল, এখনো তাই।প্রিজম নামে একটা অর্গানাইজেশন শুরু করেছিল।তাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে।তার পরও যেটুকু হচ্ছে তা কেবল ঢাকাতেই হচ্ছে।অবশ্য আরো দুটি প্রতিষ্ঠান কাজ করে।তবে যে পরিমাণ বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে তার ১০ ভাগও ব্যবস্থাপনা করা যাচ্ছে না।সুনির্দিষ্টভাবে যদি বলতে হয়,বলব—একটা ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমেআরোপাঁচটা ইটিপি হোক।এক একটি ইটিপির জন্য খরচ হবে ৬০-৮০ কোটি টাকা।পাঁচজন উদ্যোক্তাকে এর দায়িত্ব দেয়া হোক।এর মধ্যে আমরাও থাকতে পারি।আমরাও করতে চাই।লাভের জন্য না।আমরা এটাকে সামাজিক দায়বদ্ধতা করব।এখন যে বর্জ্য দেখছি,এর ১০-২০ ভাগ যদি বেসরকারি উদ্যোগে ব্যবস্থাপনার আওতায় আসে।তাহলে আমরা ২০ শতাংশ কাভার করতে পারব।এর পরের বছরআরোপাঁচজন উদ্যোক্তাকে দিতে পারেন।এভাবেই সমাধান হবে।কোনোউদ্যোগ না নিয়ে শুধু সমস্যার কথা বলতে থাকি,তাহলে তো সমাধান আসবে না।যারা এটা করবে তাদের সরকারি সহযোগিতা দিতে হবে।এর উপকার কিন্তু সরকার সরাসরি পাবে।বর্জ্য পদার্থ বাইরে গেলে রোগ ছড়ায়।সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় কাজ করতেপারলেস্বাস্থ্য খাত অনেক দূর এগিয়ে যাবে।